প্রকাশিত: ৯:১৭ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ২৯, ২০২২
ইউএস বাংলা বার্তা ডেস্কঃ রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানার কাছে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের ওপর থেকে ২২ জানুয়ারি ভোরে অজ্ঞাতপরিচয় এক ব্যক্তিকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠান পথচারীরা। হাসপাতালে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। বাহ্যিক কোনো আঘাতের চিহ্ন না থাকায় শুরুর দিকে পুলিশ ধারণা করছিল, তিনি অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়েছিলেন। ওই ধারায় থানায় মামলাও হয়। কিন্তু মর্গে ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক জানিয়ে দেন, নিহতের মাথার অভ্যন্তরে খুলি ভাঙা, এটি হত্যাকাণ্ড! এর পরই নড়েচড়ে বসে পুলিশ।

পরে ওই ব্যক্তির পরিচয়ও মেলে। তার নাম মহির উদ্দিন। বয়স ৫০ বছর। যাত্রাবাড়ী আড়ত থেকে মাছ কিনে বিভিন্ন মহল্লায় বিক্রি করেন তিনি। তার মৃত্যুরহস্য উদ্ঘাটন করতে গিয়ে বেরিয়ে আসে ভয়ংকর একটি অপরাধী গ্রুপের তথ্য। যারা রাতের শেষ ভাগে লেগুনা গাড়ি নিয়ে যাত্রী তুলে সবকিছু ছিনিয়ে নেয়। এরপর চলন্ত গাড়ি থেকে ছুড়ে ফেলে হত্যা করে। মহির উদ্দিনও পড়েছিলেন ওই অপরাধী চক্রের খপ্পরে। তদন্তের সূত্রে আলামত দেখে পুলিশ শেষ পর্যন্ত গ্রেপ্তার করে চক্রের চার সদস্যকে।
গ্রেপ্তার চারজন হলো- মো. মনজুর, আবদুর রহমান, রুবেল মিয়া এবং মো. রিপন। তারা লেগুনা গাড়িতে যাত্রী তুলে অস্ত্রের মুখে সর্বস্ব ছিনিয়ে নিত। মনজুর লেগুনার চালক, রহমান তার সহকারী (হেলপার); লেগুনায় যাত্রীবেশে থাকত রুবেল ও রিপন।
এর আগে ২০ জানুয়ারি মধ্যরাতে রাজধানীর আবদুল্লাহপুর এলাকায় বাসে উঠে ডাকাতের খপ্পরে পড়েন চিকিৎসক শফিকুল ইসলাম ও তার এক বন্ধু। টানা ৮ ঘণ্টা ধরে তাদের বাসের ভেতর নির্যাতন করে নগদ টাকা, মোবাইল ফোন, এটিএম কার্ড নিয়ে পরের দিন সকালে যাত্রাবাড়ী এলাকায় বাস থামিয়ে পালায় ডাকাতরা। এর দু’দিন পরই যাত্রাবাড়ী থেকে লেগুনায় যাত্রী তুলে যাত্রীবেশী ডাকাতদের হাতে মাছ ব্যবসায়ীকে হত্যার তথ্য পাওয়া গেল।
মহির উদ্দিনকে যেভাবে হত্যা করা হয়: মহির উদ্দিনের ছেলে খাইরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, তার বাবা আড়ত থেকে মাছ কিনে বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি করতেন। ২২ জানুয়ারি শেষ রাতে তিনি মাছ কেনার জন্য কদমতলীর বাসা থেকে পাতিল নিয়ে যাত্রাবাড়ী আড়তের উদ্দেশে বের হন। মাছ বিক্রি করে প্রতিদিন দুপুরে বাসায় ফিরলেও সেদিন ফিরছিলেন না। সন্ধ্যা পর্যন্ত বাবার সন্ধানও পাচ্ছিলেন না। পরে তারা থানায় যান। সেখান থেকে তথ্য পেয়ে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মর্গে গিয়ে দেখেন বাবার লাশ পড়ে আছে।
যাত্রাবাড়ী থানার ওসি মাজহারুল ইসলাম জানান, মর্গ থেকে ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক তাদের জানান, ওই ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়েছে। এর পরই তারা তদন্ত শুরু করেন। চারজনকে গ্রেপ্তারের পর তারা জানায়, সেদিন ভোরে সাদ্দাম মার্কেট এলাকা থেকে মহির উদ্দিনকে লেগুনায় তোলা হয়। তাকে কুতুবখালী নামিয়ে দেওয়ার কথা থাকলেও লেগুনাটি দ্রুত চালিয়ে ফ্লাইওভারে উঠে যায়। সেখানে ধারালো অস্ত্র ঠেকিয়ে মহির উদ্দিনের কাছ থেকে ৫ হাজার ৯০০ টাকা ছিনিয়ে নিয়ে তাকে চলন্ত গাড়ি থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হয়। মাথায় আঘাত পেয়ে তিনি মারা যান।
লাল পাদানিতে সেই লেগুনা শনাক্ত:পুলিশ জানায়, মহির উদ্দিনের লাশ উদ্ধারের পর পুরো ঘটনা ক্লুলেস ছিল। মামলা হওয়ার পর তদন্ত কর্মকর্তা যাত্রাবাড়ী থানার উপপরিদর্শক বিলাল আল আজাদ ফ্লাইওভার থেকে সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করেন। তাতে অস্পষ্টভাবে দেখা যায়, চলন্ত একটি লেগুনা থেকে কাউকে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। তবে অস্পষ্ট ফুটেজের জন্য লোকজন চেনা যাচ্ছিল না। তা ছাড়া গাড়িটির নম্বরও বোঝা যাচ্ছিল না। তবে লেগুনার পেছনে লাল রঙের পাদানি স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল। এরপরই তদন্ত কর্মকর্তা লাল পাদানির সেই লেগুনা খোঁজা শুরু করেন। যাত্রাবাড়ী ও আশপাশের এলাকার লেগুনা স্ট্যান্ডে কখনও তিনি হেলপার, আবার কখনও যাত্রী বেশে চালাতে থাকেন অনুসন্ধান। এভাবে অন্তত তিন শতাধিক লেগুনা যাচাই করা হয়। এক পর্যায়ে ২৫ জানুয়ারি রাজধানীর কদমতলীতে ভুলুর গ্যারেজে পাওয়া যায় সেই লেগুনা।
লেগুনার হেলপার সেজে চক্র শনাক্ত: মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক বিলাল আল আজাদ জানান, ওই গ্যারেজে লেগুনা চিহ্নিত হওয়ার পর তারা জানতে পারেন, ওই দিন লেগুনাটি চালক মনজু ও রহমান নিয়েছিল। কিন্তু তাদের মোবাইল নম্বর না থাকায় তাদের সন্ধান মিলছিল না। এর পরই তিনি লেগুনার হেলপার সেজে ওই দু’জনকে খুঁজতে থাকেন। হেলপার ও চালকের মতো করেই রাতে স্ট্যান্ডে লেগুনাতে ঘুমাতে থাকেন। এক পর্যায়ে গুলিস্তানে একটি বাসে রহমানের সন্ধান মেলে। তাকে আটকের পর মনজুকে পাওয়া যায়। দু’জনেই স্বীকার করে, ঘটনার সময়ে রিপন ও রুবেল নামে আরও দু’জন লেগুনায় ছিল। এরপর ২৬ জানুয়ারি রাতে কদমতলী এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় রুবেল ও রিপনকে।
ওই রাতে আরও দু’জনকে তুলে সবকিছু কেড়ে নেয় ওরা: গ্রেপ্তার মনজু জানায়, ২২ তারিখ রাত ২টার দিকে সে শনিরআখড়া ব্রিজে চা খেতে যায়। সেখানে পূর্বপরিচিত রুবেল ও রিপনকে পায় সে। এরপর পূর্বপরিচিত ভুলুর গ্যারেজে গিয়ে লেগুনা বের করে। ওই লেগুনায় তখন রহমান ঘুমিয়ে ছিল। এক পর্যায়ে রহমানও তাদের সঙ্গে যোগ দেয়।
মনজু আরও জানায়, তারা লেগুনাটি নিয়ে যাত্রাবাড়ী মোড়ে যাওয়ার সময়ে একজনকে তোলে। কিন্তু টাকাপয়সা না থাকায় নামিয়ে দেয়। ভোরে সেটি নিয়ে যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তায় চলে যায় সদরঘাট থেকে আসা যাত্রী ধরতে। সেখান থেকে সাইনবোর্ডগামী এক যাত্রী তোলে। ওই সময় রিপন ও রুবেল যাত্রীবেশে বসে ছিল। এক পর্যায়ে ওই যাত্রীকে ছুরি ঠেকিয়ে ব্যাগসহ টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার সময়ে স্পিড ব্রেকারে গাড়ি আটকে গেলে ওই যাত্রী গাড়ি থেকে লাফিয়ে দৌড় দেয়। এক পর্যায়ে সাদ্দাম মার্কেটের কাছ থেকে মাছ বিক্রেতাকে তোলা হয়। টাকা ছিনিয়ে নিয়ে তাকে ফ্লাইওভারে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় রুবেল ও রিপন।সুত্রঃ সমকাল
US BANGLA BARTA is proudly powered by WordPress